Saturday 14 January 2017

সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ

বিপদ সঙ্কুল সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে মধু (সুন্দরবনের তরল সোনা) সংগ্রহ অন্যতম প্রধান জীবিকাপ্রতিবছর সরকারি ভাবে মধু সংগ্রহ করার অনুমতি দেওয়া হয়। (চলে সারা এপ্রিল মাস)।  গ্রামবাসী, জেলে-মৌলেরা (মধু সংগ্রহকারী) ৫-৭ জনের দল আলাদা আলাদা বনে যান মহল করতে (মধু সংগ্রহ করা)যাওয়ার আগে গ্রামে সাড়ম্বরে ‘বনদেবী’ (বনবিবি), দক্ষিণরায়ে’র পুজো, ‘দুখেযাত্রা’র আয়োজন করেনবাঘের ডেরা থেকে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসার জন্য বাড়ির মহিলারা উপবাস করে স্নান করে সুচিবস্ত্রে দেবীর কাছে কান্নাকাটির পর মানত করে হাতে পুরোহিতকে দিয়ে লাল সুতোর মাদুলি-তাবিজ বাঁধিয়ে দেন। 

বিদায় বেলায় চোখের জল ফেলা নিষিদ্ধ। ‘প্রিয়জন’ কবে বাড়ি ফিরবেন সেই অপেক্ষায় পরিবারের লোকজন সকাল হলেই নদীর পাড়ে নদীপথ চেয়ে বসে থাকেনবাড়িতে শোকের ছায়াপালিত হয় অশৌচদেবীর পূজার্চনা, বনে যাওয়া স্বামী-সন্তানের মঙ্গল কামনা ছাড়া সমস্ত রকম আমোদপ্রমোদ বন্ধ থাকেবাড়ির প্রিয়জন বাড়িতে ফিরে এলে আনন্দে ঢাকঢোল বাজিয়ে জাঁকজমক করে বনবিবি, সত্যনারায়ণের পুজো হয়কখনও বনের ধারে, কখনও বনে ভিতরে গিয়ে দেবীকে পুজো করা হয়।  এদিকে, বাঘের মুখ বাঁধার মন্ত্র জানা একজন গুণীনকে সঙ্গে নিয়ে বনে যান মৌলেরাবনের উদ্দেশ্যে যাওয়ার আগে ‘পাঁচ পীর’ (দরিয়াপীর, সত্যপীর, মানিকপীর, কাউরপীর এবং গোরাচাঁদ)-এর নামে ‘বদর বদর’ ধ্বনি দিয়ে সকল দেবতাদের স্মরণ করে আশীর্বাদ নেন।  

বনে মধু্র চাক কাটার আগে নদীতে স্নান করে ভিজে পোষাকে কোনও গাছের গোড়ায় গরান পাতার থালা বানিয়ে গুড়ের বাতাসা দিয়ে পুজো করেনগুণীন জঙ্গল বেঁধে দেওয়ার পর শুরু হয় উড়ন্ত মৌমাছিকে লক্ষ্য করে মৌচাক খোঁজার কাজগুণীন গুঁড়িমেরে বসে গাছের ফাঁক থেকে বাঘের গতিবিধির উপর নজর রাখেসঙ্গীরা নিরাপদে থাকছে কিনা তা জানান দিতে মৌলেরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ পর পরস্পরকে  কু...কু...কু...ধ্বনির শব্দে নিজেদের বেঁধে রাখেন।  সাড়া না পাওয়া গেলে ধরে নেওয়া হয় তাঁকে বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছে।  কিংবা কোনও বিপদে পড়েছেন তিনিবেগতিক বুঝে তৎক্ষণাৎ কাজ বন্ধ করে দেনএলাকাটি বিপজ্জনক বোঝাতে কোমরের লাল গামছা খুলে গাছে বেঁধে চিহ্ন করে ফিরে আসেন গ্রামে।  বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে জীবন বাজি রেখে সঙ্গীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঘের উপরমারপিট করে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে সঙ্গীকে উদ্ধার করেও আনেননা পারলে খালি হাতে ফেরেনসংবাদ দেন বন দফতরকেএদিকে প্রিয়জন বাঘে আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকের ছায়া নেমে আসে সংশ্লিষ্ট গ্রাম ও আশপাশ এলাকাতেঅন্যান্য মধু সংগ্রহকারী দল সেই দিনের মতো কাজ বন্ধ করে দেননৌকায় ফিরে রাতে বন দেবী ও দক্ষিণ রায়ের নামে বন্দনা করে সকলের মঙ্গল কামনায় পাতায় মধুর নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো দেন।  বাঘে আক্রান্ত মৌলেরা। 
২০১৩- মৃত ২, ২০১৪- মৃত ১, ২০১৫- মৃত্যু হয়নি২০১৫- ২, ২০১৬- ৪, ২০১৭- ১ {জানুয়ারি পর্যন্ত}


No comments:

Post a Comment